জলের খুব কাছে
পুটুর সাথে আমার দেখা আমাদের ঘরের লাগোয়া বাগানে । পুটুর মা মালতি মাসি কাজ করতো আমাদের বাড়িতে । পুটু সামলাতো ওর ছোটো ভাই নাটুকে । বাগানে বসে খেলা করতো ওরা । মা কিছু খাবার দিলে পুটু যত্ন করে ভাই কে খাইয়ে তারপর নিজে খেত । আমি তখন এক বাক্সো পুতুলের মালিক । একটা জুতোর বাক্সে আমার ন্যাকড়ার পুতুল গুলো থাকতো । সারাদুপুর বারান্দায় বসে আমি পুতুলগুলোকে শাড়ি পড়াতাম ,চুল বাঁধতাম ,সাজাতাম ,বিয়ে দিতাম । আমার পিসতুতো দিদি হোস্টেলে থেকে পড়তো । আমি গাছের কোটরে পুতুল রেখে আসতাম হোস্টেলে । পুটু দূর থেকে আমার পুতুলখেলা দেখতো । তারপর বারান্দার সিঁড়িতে বসে । আমি জিজ্ঞাসা করতাম,কোন শাড়িটা পরাবো বলতো ?
---গোলাপি...
পুটু বলতো । গোলাপি ওর প্রিয় রঙ ।
---কাল তো পরেছে গোলাপি ।
---তাহলে আজ লাল টা পরাতে পারো ।
একটা চুলঅলা মেয়ে পুতুল আর দুটো শাড়ি দিয়েছিলাম পুটুকে । পরের দিন পুটু নিয়ে এলো মাটির পুতুল। কি সুন্দর ! চোখ। নাক,মুখ চুল সব আছে।
---কে বানিয়ে দিলো? আমি জিজ্ঞাসা করলাম ।
--আমি নিজে বানিয়েছি, পুটু বলল ।
---কি করে বানালি ?
--- পুকুরের এঁটেল মাটি দিয়ে ।
--- কোন পুকুর ?
--- আমাদের ওদিকে আছে ,---
---আমাদের বাড়ির কাছেও তো একটা পুকুর আছে। তাল পুকুর ।
--- দূর তালপুকুরের মাটি ভালো না । আমাদের গড়গড়ির মাটি খুব ভালো ।
--- আমাকে এক দিন নিয়ে যাবি গড়গড়িতে ?
--- তোমার মা বকবে ।
--- মা জানতে পারবে না --- দুপুরে যাবো চুপিচুপি --- নিয়ে চল না ---
--- আচ্ছা নিয়ে যাবো ।
মায়ের ভাতঘুমের সুযোগে আমি আর পুটু একদিন দুপুরে চুপিচুপি বেরিয়ে এলাম বাড়ি থেকে । পুটুর কোলে সবসময় ওর ভাই থাকে । আজ নেই । কেমন হালকা দেখতে লাগছিলো ওকে । ওর পাঁশুটে রঙের চুল লাল ফিতে দিয়ে পনিটেল করা। মাঝি পাড়া তে দুটো কুকুর তাড়া করলো পুটুকে । পুটু প্রাণপনে দৌড়াচ্ছে । পিছনে আমি –পুটুওওওওওওও । ঢিল ছুড়ে কুকুর গুলো তাড়ালাম । অনেকটা দৌড়ে হাঁপাচ্ছিলাম দুজনে । তারপর খুব হাসি পেলো আমার বিনা কারনে । পুটুও হাসছে । হাসতে হাসতে মুখ চোখ লাল । মাঝিদের এক ছেলে পেরিয়ে যাচ্ছিলো । হাতে গুলতি । কাঁধে গামছা । খালি গা। মিশ কালো ।
---তুরা হাসছিস কেনে ? জিজ্ঞাসা করলো ।
--- বেশ করছি ! পুটু জবাব দিলো ।
--- ক্ষ্যাপা বটিস ? ছেলেটা আবার জিজ্ঞাসা করলো ।
---হ --পুটু বলল ।
আমাদের আবার হাসি পাচ্ছিলো । হাসতে হাসতে দৌঁড়াতে লাগলাম । ছেলেটা দাঁড়িয়ে রইলো বোকার মতো । আর একটা বাঁক পেরুতেই পুকুর । সান বাঁধানো ঘাট নয় । দুটো বড়ো বড়ো পাথর শুধু ঘাটে । পুকুরের এক দিকে কুটুস ঝোপ আর এক দিকে বন ধুতরো । জলে মেঘের ছায়া । একটা বউ কাপড় কাচছে । পুটু পাথরে গিয়ে দাঁড়ালো । জলের খুব কাছে । জলের ভেতরে হাত ডুবিয়ে তুলে আনলো এক খাবলা মাটি । হাসি উপচে পড়ছে ওর মুখে । চটি খুলে জলে নেমে জল ছিটালাম পুটুর রংচটা ফ্রকে । পুটু মাটি রেখে জল ছুঁড়ে মারলো আমার মুখে। আমি আবার জল ছুঁড়লাম --- হাসছিলাম আমরা । পুকুরের বাতাসে ভাসছিলো জলের আর হাসির রেনু । গুঁড়ো গুঁড়ো ফুলের মতো ।
বাড়ি ফিরতে দেরি হয়ে গেলো । ভাগ্যিস মা বেরিয়েছিলো রক্ষা কালীর পুজো দিতে। জামা ছেড়ে চুপচাপ পড়তে বসে গেলাম । পরের দিন পুটু আর আমি দুজনে মিলে মাটির পুতুল বানালাম । আমি বড়ো হচ্ছিলাম । পুটুও । গ্রামের প্রাইমারি স্কুল ছেড়ে ভর্তি হলাম বড়ো স্কুলে । পুটু ভর্তি হলো না । ওর মার শরীর ভালো নেই । বড়ো স্কুলের মেয়েদের দেখে আমার চোখ ধাঁধিয়ে গেলো । তারা কেউ মাটির পুতুল খেলে না । গল্পের বই পড়ে। নাচ শেখে ,গান শেখে । তাদের গায়ে পুটুর মতো সরষের তেলের নয় ,মিষ্টি সাবানের গন্ধ । কুসুমিতা ,পারমিতা ,বৈশাখী ,অলিভিয়া তাদের নাম । পড়াশুনায় সবাই ভালো ,সুন্দর ড্রেস পরে ,ভালো টিফিন নিয়ে আসে । এমনকি পাশের বয়েজ স্কুলে বৈশাখীর লাভার আছে !! সে তাকে চিঠি দেয়। এদের সাথে বন্ধুত্ব করার জন্য আমি মনে মনে পাগল হয়ে উঠলাম । প্রথম প্রথম ওরা আমাকে পাত্তা দিতো না। আমার সাধারণ জামাকাপড় ,তেল দেয়া চুল ,অতি সাধারণ চেহারা মোটেও তাদেরকে ইমপ্রেস করতে পারেনি । আমি ধীরে ধীরে পড়াশুনা করে একটু একটু করে দলে ঢুকলাম ওদের । তবু একটা দূরত্ব থেকে গেলো । আমি কোনোদিন আমার পুতুলের বাক্সটার কথা ওদেরকে বলি নি ।
পুটুর মা ততদিনে আমাদের বাড়ির কাজ ছেড়ে দিয়েছে । পুটুর আবার ভাইবোন হবে । একদিন হঠাৎ পুটু দিদিমনির সাথে আমাদের ক্লাসে এলো । ইস্ত্রি না করা ন্যাতানো জামা ,কারো পুরানো বড়ো জুতো ,আর পুরনো তাপ্পি মারা একটা ব্যাগ নিয়ে পুটু স্কুলে এসেছে । আমাকে দেখে পুটু এক গাল হাসলো । আমি হাসলাম না । ভয়ে লজ্জায় দূরে সরে গেলাম । ইসস - বৈশাখী কুসুমিতা এরা যদি জানতে পারে পুটু আমার বন্ধু ! আমার সাথে আর মিশবে না । পুটু আমাদের ক্লাসেই লাস্ট বেঞ্চে বসে । টিনের টিফিন কৌটোতে খাবার আনে। পড়া পারে না । কুসুমিত বৈশাখী সবাই হাসে ওর জুতো আর ব্যাগ দেখে । আমাকে দেখলে হেসে কথা বলতে আসে পুটু । আমি পালিয়ে বাঁচি । কিন্তু একদিন পালাতে পারলাম না । কুসুমিতা পছন্দ করে শাহরুখ খানকে । আমরা গোল হয়ে বসে হিন্দী গান করছি । আমি গানটা জানিনা । কিন্তু লিপ মেলাচ্ছি । পুটু হটাৎ এসে আমার হাত ধরলো ,
--আমার আর একটা বোন হয়েছে জানিস !
বন্ধুদের মধ্যে হাসির হিল্লোল উঠলো ।
---ও তোর বন্ধু ?নাক কুঁচকে বৈশাখী জিজ্ঞাসা করলো ।
--- না, বলে দৌড়ে চলে গেলাম আমি ।
পুটু কিছুক্ষন দাঁড়িয়ে থেকে চলে গেলো । ওরা সবাই মুখটিপে হাসছিলো ।
জীবন বিজ্ঞানের দিদিমনি ছিল আমার সবথেকে প্রিয় । খুব সুন্দর পড়াতেন । দেখতেও খুব সুন্দর । আমি সব পড়া করে যেতাম । দিদিমনি বললেন ,সোমবার তোমরা সবাই প্রাকটিক্যাল খাতা আনবে ,আমি ব্যাঙের পৌষ্টিক তন্ত্র আঁকাটা শেখাবো।কেউ ভুলবে না ।
সেদিন বিকেলেই বাবাকে নিয়ে দোকানে গেলাম । নীলের উপর সবুজ প্রিন্টেড খাতাটা খুব পছন্দ হল । ভেতরে মোটা কাগজ । একদিকে সাদা ,একদিকে রুলটানা । বেশ দামি । কম দামি খাতাও ছিল । বাবার দিকে তাকালাম ,বাবা হাসছে । নাচতে নাচতে নীল দামী খাতাটা নিয়ে বাড়ি এলাম । সোমবার খাতাটা ব্যাগে ঢোকালাম আগে । ক্লাসে ব্যাগ রেখে মাঠে গল্প করতে গেলাম ।
প্রথম পিরিয়ডেই জীবনবিজ্ঞান । দিদিমনি একটা মিষ্টি পিঙ্ক কালারের শাড়ি পড়েছেন । খুব সুন্দর লাগছে দেখতে ।
দিদিমনি বললেন ,খাতা বের করো !
আমি আনন্দে তাড়াতাড়ি খাতা বের করতে গিয়ে দেখি ,ব্যাগে খাতা নেই । চারদিক খোঁজাখুঁজি করে কোথাও খাতা পেলাম না ।
দিদিমনি জিজ্ঞাসা করলেন ,কি হয়েছে ?
আমি কাঁদো কাঁদো হয়ে বললাম ,খাতাটা খুঁজে পাচ্ছি না দিদিমনি ---
দিদিমনি বললেন ,খাতাটা তো উড়ে যেতে পারেনা ,দেখো ভালো করে --
ক্লাসের মনিটর মণিদীপা আমাকে সাহায্য করার জন্য এগিয়ে এলো । আমি আর মণিদীপা সবার কাছে খোঁজ করছি ,নেই কোথাও -- মণিদীপা ফিসফিস করে বলল ,পুটু নিয়েছে মনে হয় -- ওর মুখটা দ্যাখ !
আমরা পুটুর বেঞ্চের দিকে এগিয়ে গেলাম। পুটুর তাপ্পিমারা ব্যাগ থেকে উঁকি দিচ্ছে আমার নীল খাতাটা । পুটু ভয়ে ত্রাসে তাকিয়ে আছে আমাদের দিকে ।
আমি বললাম ,ছেড়ে দে --- মনে হয় বাড়িতে ফেলে এসেছি --
দিদিমনি বললেন ,কি হয়েছে ?
আমি দিদিমনির কাছে গিয়ে বললাম ,খাতাটা বাড়িতে ফেলে এসেছি দিদিমনি -- পরের দিন নিয়ে আসবো ।
দিদিমনি খুব বিরক্ত হলেন ,সারা ক্লাসকে ডিসটার্ব করেছো তুমি -- এর জন্য তোমাকে পানিশমেন্ট পেতে হবে ।
আমি বললাম ,ভুল হয়ে গেছে দিদিমনি -- ক্ষমা করে দিন ।
দিদিমনি ভ্রূ কুঁচকে বললেন ,আর কোনোদিন এমন করবে না -- যাও সিটে গিয়ে বসো।
পরের দিন পুটু স্কুল এলো না । তারপরের দিনও না । পুটু আর স্কুল আসে না । মালতীমাসি আমাদের বাড়িতে কাজ করে না । পুটুর কথা কাউকে জিজ্ঞাসা করতে পারিনা ।
দুদিন ধরে খুব বৃষ্টি । ভিজে ভিজে আমার ঠান্ডা লেগে গেলো । মাথা ব্যাথা করছে পড়তে বসে । পড়া মুখস্ত করতে পারলাম না । স্কুলে পড়া না পেরে বোকার মতো তাকিয়ে আছি । তাকিয়ে দেখি বৈশাখী, কুসুমিতা মুখ টিপে হাসছে । যেমন করে পুটুর জুতোর দিকে তাকিয়ে হাসতো ।
বাড়ি এসে ভাত আর ডাল মাখছি আর মাখছি । খেতে ইচ্ছে করছে না । অনেক দিন পর পুতুলের বাক্সোটার কথা মনে পড়ছে । তাকের উপর থেকে পেড়ে আনলাম বাক্সোটা । ধূলো পড়ে গেছে । ভেতরে শাড়ি পড়ে সারি সারি শুয়ে আছে আমার পুতুলেরা ।
দীর্ঘশ্বাস ফেলে চটি পরে বাইরে বেরিয়ে এলাম । কেমন অন্যমনস্ক হয়ে হাঁটছি। হাঁটছি । হঠাৎ দেখি আমি কুমোর পাড়ায় চলে এসেছি । এখানে পুটুদের বাড়ি । একজন লোক কে জিজ্ঞাসা করলাম ,সে দেখিয়ে দিলো । পুটু ওর বোন কে কোলে নিয়ে দাঁড়িয়ে ছিল । সামনে একটা কলতলা ,সেখানে শ্যাওলা ধরা ইট পাতা । ঘর গুলো কেমন যেন। ছোটো ছোটো । গা ঘেঁষা ঘেঁষি। সামনে একটা বিশাল বড়ো নিম গাছ । পুটু আমাকে দেখে দৌড়ে ঘরে ঢুকে গেলো । আমি একা দাঁড়িয়ে আছি । পুটু কিছুক্ষন পরে ফিরে এলো । হাতে আমার প্রাকটিক্যাল খাতাটা । আমি মাথা নেড়ে বললাম ,তুই রেখে দে ,আমি নতুন কিনে নিয়েছি ।
পুটু কিছু বললো না ,চুপ করে দাঁড়িয়ে আছে ।
আমি জিজ্ঞাসা করলাম ,স্কুল যাবি না আর ?
--- না।
পুটু জবাব দিলো ।
--- ও --
আমার আর কিছু বলার নেই ,বাড়ি ফিরে যাচ্ছি পায়ে পায়ে । বাঁকের কাছে এসে পিছন ফিরে তাকালাম । পুটুও তাকিয়েছিলো । হঠাৎ আমি ছুটতে শুরু করলাম । এক ছুটে পুটুর কাছে । বেশ হাঁফ ধরেছে আমার । জোরে জোরে উঠছে নামছে আমার রোগা বুকের খাঁচা ।
আমি চেঁচিয়ে জিজ্ঞাসা করলাম ,তুই স্কুল যাবি না কেন পুটু ?
পুটু অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে আমার দিকে । আমার চুলের গার্ডার ছিঁড়ে গেছে। পনিটেল খুলে ঝাপড়ি চুল ছাড়িয়ে পড়েছে মুখে। উত্তেজনায় মুখ লাল । কাঁপছে ঠোঁট --... যেন পুটুর উত্তরের উপর আমার শুধু নয় এই বিশ্ব প্রকৃতির সব কিছু নির্ভর করছে । স্তব্ধ হয়ে আছে কলতলা ,শ্যাওলা ধরা ইট গুলো ,পাশে নিম গাছটা --- পুটুর কাকার মেয়ে বুড়ি এসে দাঁড়ায় । সে অবাক হয়ে দেখছে আমাকে । পুটু বুড়ির কোলে ওর বোনকে দিয়ে হ্যাচকা টান দেয় আমার হাতে । পড়ে যেতে যেতে সামলে নিই আমি । পুটু ছুটছে ,পিছনে আমি ---- পুটুর খালি পা ,উড়ছে ধুলো ,উড়ছে ওর গোলাপি ফ্রক ---।বাতাস কেটে ছুটছি সাই সাই করে । পুটু আর আমি এলাম সেই পুকুর পাড়ে । পুকুরে কেউ নেই । জল খুব কালো । তির তির করে হওয়াতে কাঁপছে জলের বুক । জলের খুব কাছে বসে আছি আমি আর পুটু । আমাদের মুখে কোনো কথা নেই । জলে ঘাই মারছে ছোটো মাছ ,ফড়িং উড়ছে ,চই চই করে জলে চরছে দুটো পাতি হাঁস । সারা আকাশ উপুড় হয়ে তাকিয়ে আছে আমাদের দিকে। জলের খুব কাছে বসে আছি আমি আর পুটু
No comments: